Saturday, February 5, 2011

কলকাতার কনসার্ট

কুঁদঘাটের বাস স্ট্যান্ড এখন প্রায় ফাঁকা | একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে ,ভিতরে দু একটা লোক মাত্র | একদিকে কয়েকটা ফাঁকা  ট্যাক্সি , অন্য দিকে ওদেরই ইউনিয়নের ছাউনিতে বসে কয়েকজন হাতে চায়ের ভাঁর নিয়ে গল্পগুজব করছে | দুটো কুকুর ফেলে দেওয়া কোনো খাবারের উচ্ছিষ্ট নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত | দূরের এক কোনে দাঁড়িয়ে একজন  মনে হয় জলত্যাগে  নিবিষ্ট |
রাস্তাঘাটে লোকজন এখন  বেশি নেই | ফুটপাথের পাশে কিছু দোকান খোলা, কিছু খুলব খুলব করছে | উল্টোদিকে রাস্তার ধারের স্টলগুলোর দু একটায় সন্ধ্যার প্রস্তুতি চলছে ,অন্যগুলোয় ঝাঁপ এখনো বন্ধ | এখন বিকেল পাঁচটা , এখানকার কলকাতা শ্বাস নিচ্ছে , সকাল থেকেই ত দৌড়ের শুরু , দুপুরের পর এই একটু বিশ্রাম , সিনেমার ইন্টার ভালের মত আর কি , কিছু পরেই রাস্তার আলো জ্বলে উঠবে ,সন্ধ্যার পর্ব শুরু হয়ে যাবে |
আমি হেঁটে মেট্রো স্টেশনে পৌছলাম , একটা কাউন্টারের সামনে পিস বোর্ডে লেখা 'সঠিক ভাড়া দেবেন' ,সেই কাউন্টারের সামনেই দু একজনের পিছনে লাইনে দাঁড়ালাম | আমি খুচরো নিয়ে বেরই ,সঠিক ভাড়া দেব বলে, তাড়াতাড়ি ও হবার সম্ভাবনা , কিন্তু সব সময় দেখি খুব কম লোকেই সঠিক ভাড়া দেয় | কাউন্টারের লোকটি কিছু বলে না , গুনে গুনে খুচরো ফেরত দেয় | একদিন জিজ্ঞেস করতে বলল, 'কি করবো বলুন, কেউ মানে না ,ঝগড়া করবো ?' সত্যি কেউ  মানে না, ঝগড়া করে কে আর অপ্রিয় হয় |
কেউ কেউ মানে , তাদেরই ভোগান্তি | বেশিরভাগই মানে না ,এটাই কলকাতার বৈশিষ্ট্য | এই যে স্টলগুলো মেট্রো  স্টেশন চালু হবার পর দেখতে দেখতে রাস্তার একধার দিয়ে বেড়ে চলল , এটা নিশ্চয়ই কোন আইন মেনে নয়, কিন্তু লোকে মেনে নিয়েছে |সন্ধ্যের পর এদের রমরমা | কোথাও চপ কাটলেট ভাজা হচ্ছে ,চাউমিন তৈরী হচ্ছে, কোথাও মাটন বা এগ রোল | এক জায়গায় আবার মোমো , তার গুনাগুন যাই হোক না কেন | রাস্তায় আলো জ্বলে উঠলে এই রাস্তায় ভিড় বেড়ে ওঠে , অফিস ফিরতি মানুষ , দোকানে কেনাকাটা করা মানুষ, এছাড়া ত রিক্সা , ট্যাক্সি অটো র চালকেরা  আছেই | পথ চলতি মানুষের অনেকেই দাঁড়িয়ে যায় এই সব স্টলের সামনে , সারাদিনের খাটাখাটুনির পর ক্ষুধার উদ্রেক স্বাভাবিক | অতএব দোকানগুলো লোকের সুবিধেই করে দিয়েছে | এছাড়া এদের পিছেনে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের মদত থাকতেই পারে , সুতরাং চুপ থাকাই ভালো |
 আমি বাড়ি ফিরছি, রাত আটটা, রাস্তা এখন প্রানবন্ত , প্রানের জোয়ারে ভাসছে | সাইকেল,রিক্সা,অটো,বাস,গাড়ী চলছে ত চলছেই , পথচারীদের কথা আর নাই বললাম | এরই মধ্যে কোথাও একটা রিক্সা রাস্তার মাঝেই সওয়ারী নামিয়ে দরকষাকষি শুরু করলে আর কথা নেই, তার ইচ্ছে হলে সে করতেই পারে, অটোও হটাত দাঁড়িয়ে পড়তে পারে  রাস্তার মাঝে , এটা ওদের গণতান্ত্রিক অধিকার | তাছাড়া ওদের ইউনিয়ন আছে , অতএব পুলিশ থাকলেও নিশ্চুপ | মাঝখান থেকে কিছু সময়ের যানজট , গাড়ির হর্ন, কোলাহল | ওদিকে একটা নতুন স্টলে সিডি,ডিভিডি বিক্রি হয়, সেখানে সবসময় কোনো না কোনো গান বাজছে, বেশ উচু পর্দায় | সব মিলিয়ে একটা কনসার্টের মেজাজ এসে যায়, তবে তার জন্যে শুধু কান থাকলেই হবে না ,মন চাই | অবশ্য কানে টান পড়লে মন কেন, মাথাই চলে আসে এত জানা কথা |
 অসুবিধে গাড়ির চালকদের | আমাকে মাঝে মাঝে গাড়ী নিয়ে বেরোতে হয়, সন্তর্পনে চালাই, পথচারীদের বাঁচিয়ে, রিক্সা ,সাইকেলে ধাক্কা না মেরে চলে আসি কোনমতে | কোথাও একটু লেগে গেলে ত কথাই নেই, দোষ গাড়ির এ ত জানা কথা | দরিদ্র জনসাধারনের এই দেশে গাড়ী থাকা ত কোনো গুনের কথা নয়, হলোই বা আপনি রোড টাক্স দিচ্ছেন, হলোই  বা সাইকেলটা বেখাপ্পা আপনার সামনে এসে পড়েছে অথবা ওর ত লাগেনি | কে শুনবে !
সন্ধ্যের পর কুঁদঘাটের এই মেলা এমন কিছু স্বতন্ত্র নয় অবশ্য , একই চিত্র বেহালার ট্রাম ডিপোর সামনে অথবা যাদবপুরে | এটা কলকাতা স্পেশাল | রাজীব গান্ধী বলেছিলেন কলকাতা মুমূর্ষু , মৃত্যুমুখী, বা মৃতপ্রায় | এ নিয়ে অনেক সোরগোল উঠেছিল অবশ্য, অনেক কলকাতাপ্রেমী প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন | সত্যিই ত, কে বলে কলকাতা মুমূর্ষু , অতি সতর্কতার সাথে রাস্তাটা পার হতে হতে ভাবছিলাম , এখানে ত প্রানের আতিশয্য | টলির নালায় জোয়ার না থাকতে পারে, নোংরা ফেলে ফেলে সেটাকে নর্দমা করে ফেলা হয়েছে তাতেই বা কি, আমাদের প্রানের জোয়ার আটকায় কে ?

No comments:

Post a Comment